Home / Exclusive / ই-কমার্সে সম্ভাবনাময় খাত টাঙ্গাইলের মৃৎশিল্প

ই-কমার্সে সম্ভাবনাময় খাত টাঙ্গাইলের মৃৎশিল্প

মৃৎ শব্দের অর্থ মাটি। এই শিল্প বলতে সুন্দর ও সৃষ্টিশীল বস্তুকে বুঝানো হয়। মাটি দিয়ে তৈরি যে শিল্প অনিন্দ্য সুন্দর, শিল্পীদের আবেগ ও শৈল্পিক ছোঁয়ায় দৃষ্টিনন্দন কোন অবয়বে রূপ পায় তাই মৃৎশিল্প। এই শিল্পে বিভিন্ন উপাদানে গ্রামীণ বাংলার হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ সব কিছু ফুটিয়ে তুলতে পারেন শিল্পীরা । যারা মাটি দিয়ে এসব জিনিসপত্র তৈরি করেন তাদের বলা হয় কুমার। যে স্থানে তারা এসব তৈরি করে সেই জায়গাকে বলা হয় কুমারশালা। এদেশের কুমার শ্রেণী হিন্দুদের পাল পদবীতে পরিচিত।

শত শত বছরের পুরোনো আমাদের এ ঐতিহ্য। একটা সময় গ্রামে এমন কোন বাড়ি ছিলোনা, যেখানে মাটির তৈরি জিনিস শোভা পায়নি। একটা সময় গ্রামে সবাইকেই দেখেছি মাটির পাতিলে রান্না করতে ও মাটির কলসে পানি রাখতে। সেই সময় ফ্রিজ ছিলোনা, কিন্তু মাটির কলসের পানি সবার তৃপ্তি মিটাতো। এখন এসবই অতীত। বাবাকে বলতে শুনি এখনও মাটির চুলায়, মাটির হাড়িতে রান্নার যে স্বাদ তারা পেয়েছে তা নাকি গ্যাস এর চুলায় হয়না। এভাবেই নিত্যদিনের গৃহস্থ কাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলো আমাদের মৃৎশিল্প। শুধু বাংলাদেশেই নয় চীনেও এ পণ্যের ব্যাপক ব্যবহার ছিলো। বলা হয়ে থাকে চীনের থাংশান শহরেই মৃৎশিল্পের উৎপত্তি। ফলে চীনের এই শহরকে মৃৎশিল্পের শহর বলা হয়।

অতীতে গ্রাম শহর ভেদাভেদ ছিলো না। সবজায়গাতেই প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই থাকতো মাটির প্লেট, গ্লাস, সানকি, জগ, মগ, চায়ের কাপ, বোল, হাঁড়ি, বাটি, ঘটি, কলস, পিঠা তৈরির ছাচ, মটকা, কূপিবাতি এবং প্রদীপসহ অনেক কিছুই। এখন যুগের পরিবর্তন হয়েছে। এসেছে কাঁচ, প্লাস্টিক, সিরামিক, স্টীল ও মেলামাইনের পণ্য। টেকসই এ পণ্যগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে উঠতে পারছেনা মাটির তৈরি জিনিসপত্র। তাই কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের এই ঐতিহ্য।

প্রাচীণতম নিদর্শনে ভরপুর টাঙ্গাইল শহর এবং শৈল্পিক ছোয়াতে ঐশ্বর্য মন্ডিত। টাঙ্গাইল জেলা একটা সময় মৃৎশিল্পের জন্য খুব বিখ্যাত ছিলো। এখানকার এটেল মাটি গুলো এই কাজের জন্য উপযোগী এবং টেকসই। শত শত বছর আগে থেকেই টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলা ছিলো মৃৎশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ এলাকা। একটা সময় এই অঞ্চলে হাড়ি, পাতিল, মটকি, চারি, দইয়ের পাত্র, বিভিন্ন গৃহস্থালী দ্রব্যাদি ও মূর্তি ইত্যাদি ব্যাপক ভাবে তৈরি হতো । এই পণ্যগুলি শুধু এলাকার চাহিদা মেটানো নয় বরঞ্চ দূর দূরান্তে চলে যেত।

কালিহাতি পৌরসভার উত্তর ও দক্ষিণ বেতডোবা, কোকডহরা, বল্লা, নাগবারি,নারান্দিয়া ইউনিয়নে এখনও অনেক কুমার পরিবারের বসবাস। জানা যায় এখনও উত্তর ও দক্ষিণ বেতডোবায় ৭০ টি পরিবার, কোকডহরা ইউনিয়নে ৫০ টি পরিবার, বল্লায় প্রায় ৯০ টি পরিবার, নাগবাড়িতে ঘোনা বাড়ির প্রায় ১৬ টি পরিবার, পালিমা ও পাথালিয়া তে প্রায় ১০০ টি পরিবারের বাসস্থান রয়েছে । এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে অতীতে এই এলাকাগুলো মৃৎশিল্পে কতটা প্রসিদ্ধ ছিলো।

এক সময় মির্জাপুর উপজেলায় প্রায় ১২ হাজার মানুষ মাটি দিয়ে তৈরি এই পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলো। কিন্তু বর্তমানে হাজার খানেক কুমারও খুঁজে পাওয়া যায়না এখানে। কিন্তু এখন এই পেশার সঙ্গে জড়িত কুমাররা খুব হতাশ। এখানে কুমারদের কাছেই শুনতে পাওয়া যে, তারা ৬ মাস মৃৎশিল্প তৈরি করতেন বাকি ৬ মাস বিভিন্ন ভাবে হাটে বাজারে ও বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি করতেন। কিন্তু এখন আধুনিকতার ছোঁয়াতে তাদের এই পেশায় ভাটা এসেছে। এমনকি কোকডহরার অনেক পরিবার ভিটা মাটি ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছে । বাপ দাদার আমলের এ পেশাকে ধরে রাখতে পারছে গুটিকয়েক পরিবার। যে কুমার পাড়ায় মৌ মৌ করতো মাটির গন্ধ, সেখানে এখন আর ঐ গন্ধ নেই, নেই নারী পুরুষের ব্যস্ততা, হাটে হাটে নেই মাটির তৈরি জিনিসের পসরা।

এ শিল্পের প্রধান উপকরণ এটেল মাটি, জ্বালানি কাঠ, শুকনো ঘাস, খড় ও বালি। একটা সময় ছিলো যখন মাটি নিয়ে এসে তারা স্তূপ করে রাখতো এবং পরবর্তী তে সেগুলো ব্যবহার করে জিনিসপত্র বানাতো। কিন্তু এখন কাঠ কিনতে হয়, মাটি ও কিনতে হয়। একদিকে খরচ বাড়তি অন্যদিকে কম চাহিদাতে এই ব্যবসা একেবারে ই হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে।তবে এখন অনেকেই শুধু দইয়ের পাত্র বানায়। যেখানে ১০০ মাটির পাত্র তৈরিতে খরচ হয় ৫০০ টাকা কিন্তু বিক্রি করতে হয় ৬০০ টাকায় ৷ এত কষ্টের পারিশ্রমিক হিসেবে এ যেন কিছুইনা।

অনেক কুমার খরচাপাতি ও ব্যবসা সচল রাখতে ঋণ নিচ্ছে। এরফলে পরবর্তীতে আরো বেশি বিপাকে পরে যাচ্ছেন তারা। অথচ এই শিল্পের উন্নয়ন হলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ভূমিকা রাখতে পারবে। সেই সঙ্গে প্রাচীন এই ঐতিহ্যও সংরক্ষিত হয়ে থাকবে ৷ মাটির এই শিল্প ধরে রাখতে যেমন দরকার সরকারী সহযোগীতা, তেমনি প্রয়োজন বিভিন্ন উদ্যোগের। অপরদিকে এখনও পাড়ায় পাড়ায় কুমাররা একেবারে প্রাচীনকালের ম্যানুয়াল পদ্ধতিতেই এসবের বিভিন্ন আকৃতি দেয়, নকশা করে এবং রোদে শুকিয়ে আগুনে পুড়ে পণ্য ব্যবহার উপযোগী করে তোলে। আধুনিকতার কোন ছোঁয়া এ শিল্পে আসেনি ।

তবে হ্যা, শহুরে পরিবেশে এখন আধুনিকতার ছোয়া লাগছে। যেখানে মাটির তৈরি জিনিস ঘর, রেস্টুরেন্ট অফিসের শোভাবর্ধক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ের কুমাররা এসবকে রং তুলিতে রাঙাতে পারছেনা। কারণ তারা এদিকে অদক্ষ। এরফলে কম মূল্যেই বিক্রি করতে হচ্ছে কঠোর পরিশ্রমে তৈরি এসব পণ্যগুলি। যদি তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে তারা দক্ষ হবে এবং তাদের দিন অবশ্যই ফিরবে। কেননা যাদের হাতের ছোয়া যুগের পর যুগ রঞ্জিত ও ঐশ্বর্যমন্ডিত হয়েছে এবং সাক্ষী হয়ে রয়েছে অনেক ইতিহাসের, তারা রঙ তুলির ব্যবহার জানলে আরো অনেক উন্নত হবে এই শিল্পক্ষেত্রটি। কুমাররা আকৃষ্ট হবে আবারো এই পণ্যকে রাঙিয়ে তুলতে। মৃৎশিল্প রক্ষার্থে অবশ্যই সরকারি বেসরকারি সংস্থার এগিয়ে আসা এখন সময়ের দাবী।

আশার বাণী এটাই যে আমাদের দেশে শিল্পকলায় যুক্ত অনেকে শিক্ষিত উদ্যোক্তা এখন নিজেরাও এমন উদ্যোগ গ্রহন করছে। কিছু উদ্যোক্তা এই খাতকে বেঁছে নেওয়ার ফলে, আমাদের এই শিল্প রপ্তানী হচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডার মত দেশ গুলোতে। ফুলের টব, গার্ডেন আইটেম, লাইট, মাটির তৈরি তৈজস এগুলোর মধ্যে অন্যতম। তবে সুদিন তখনই আসবে যখন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে হারিয়ে যাওয়া এই শিল্পের বিকাশ ঘটবে ও পূর্বের মতো কাজ বাড়বে। আমরা শুধু বিশেষ দিনেই নয় দৈনন্দিন ব্যবহারেও এ পণ্যগুলোকে ব্যবহার করতে পারি। সেই সঙ্গে নিতে হবে উদ্যোগ, বাড়াতে হবে সচেতনতা।

মাটির তৈরি তৈজসপত্র কতটা উপকারী তা নিয়ে কিছুটা জেনে আসি চলুন-

◑ প্লাস্টিকে বিপিএ কেমিক্যাল থাকে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। প্লাস্টিকের বোতলে পানি সংরক্ষণের ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ে। কিন্তু মাটির পাত্রে পানি রাখা স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ ৷ এতে কোন স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই। ◑ প্লাস্টিকের পাত্রে পানি রাখলে তাতে পানিতে থাকা টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমিয়ে দেয় । কিন্তু মাটির পাত্র টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বজায় রাখে এবং বিপাক ক্রিয়া শিক্তিশালি করে । ◑ মাটি ক্ষারজাতীয়, এরফলে এটি পানির পিএইচ লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখে। ফলে মাটির যে কোন পাত্রে এসডিক খাবার রান্না হলে এর ক্ষতিক্ষারক উপাদান নিস্ক্রিয় হয়ে যায়।

◑ মাটির পাত্রে খাবার সংরক্ষণ করলে স্বাদের কোন পরিবর্তন হয়না। ◑ মাটির পাত্র এক্ববারেই প্রাকৃতিক তাই এতে খাবার রান্না কিংবা সংরক্ষণ করা হলে খাবারের পুষ্টিগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে। ষোল আনা বাঙালী ছাপ শুধু বৈশাখেই নয়, এটি হতে পারে আমাদের অভ্যাস, আমাদের নিত্য নৈমিত্তিক কাজের উপকরণ। আমাদের অনেক কুমারদের আশার আলো হতে পারে ই- কমার্স । ই-কমার্সের মাধ্যমে যত দ্রুত এই সম্ভাবনাকে তুলে ধরতে হবে। যা অন্য কোন মাধ্যমে সম্ভব নয়। মাটির তৈজসপত্র ভঙ্গুর হওয়ার কারনে অনেক সময় পণ্য ডেলিভারি সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে এই উদ্যোগ । তবে প্যাকেজিংয়ে সাবধানতা অবলম্বন করলে তা অনেক টাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। তবেই টাঙ্গাইলের পুরানো এই ঐতিহ্য ফিরে আসতে পারে।

ই-কমার্সের মাধ্যমে তৈরি হতে পারে মৃৎশিল্প নিয়ে অনেক উদ্যোগ এবং হারানো কুমারপাড়া আবারো ফিরে পেতে পারে তার জৈলুস। এই খাতে রয়েছে প্রচুর সম্ভাবনা। কেননা মানুষ এখন যেমন সৌখিন হয়ে উঠছে তেমনি বাড়ছে সচেতনতাও। এই জায়গা থেকেই প্রচুর কন্টেন্ট তৈরি করে প্রচারে এগিয়ে আসতে হবে ই-কমার্স সেক্টরের মাধ্যমেই।

About admin

Check Also

পাহাড়ে বাতাসে ফলের ঘ্রাণ

চলছে জ্যৈষ্ঠ মাস। এখন হবিগঞ্জে পাহাড়ের কেমিক্যালমুক্ত ফলের ঘ্রাণে স্থানীয়দের মন মাতোয়ারা। দোকানিরা পাহাড়ের হরেক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *